একজন পুরুষের জন্য একাধিক স্ত্রী রাখা ইসলামের পূর্ব গোটা বিশ্বের প্রায় সকল ধর্মে বৈধ বলে মনে করা হত। আরব, হিন্দুস্থান, ইরান, মিশর, ইউনান, (গ্রীক) বাবেল, অষ্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে বহু বিবাহের প্রচলন ছিল এবং এই স্বভাবগত প্রয়ােজনীয়তাকে আজও কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। প্রসিদ্ধ খ্রিষ্টান পণ্ডিত মি: ডেভিট পোর্ট বহু বিবাহের সমর্থনে ইঞ্জিলের অনেক আয়াত বর্ণনার পর লিখছেন: “এই আয়াত সমূহ থেকে একথা প্রতীয়মান যায় যে, একাধিক বিবাহ শুধু পছন্দনীয়ই নয় বরং খোদা তায়ালা তাতে বিশেষ বরকত দিয়েছেন।”
অবশ্য এখানে একটি বিষয় দেখার যোগ্য যে, ইসলামের পূর্বে বহু বিবাহের কোন সীমা নির্ধারিত ছিল না। এক এক ব্যক্তির বিবাহের অধীনে হাজার হাজার স্ত্রী থাকত। খ্রিষ্টান পাদ্রীরা বহু বিবাহে অভ্যস্ত ছিল। ষোল’শ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জার্মানে এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। কনস্টান্টিনোপলের রাজা ও তার উত্তরসূরিরা বহু স্ত্রী গ্রহণ করেছিল। হিন্দুদের বেদ নামক গ্রন্থের শিক্ষায় বহু বিবাহ বৈধ ছিল এবং তাঁতে একই সময় দশজন, তের জন, সাতাইশ জন স্ত্রী রাখার অনুমতি রয়েছে।
মোট কথা, ইসলামের পূর্বে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন রাষ্ট্রের এবং ধর্মীয় ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, ইহুদী, খ্রিষ্টান, হিন্দু, আর্য এবং পারসিক কোনো ধর্ম বা আইন-কানুন বহু বিবাহের কোনো সীমারেখা নির্ধারণ করেনি।
ইসলামের প্রাথমিক যুগেও বহু বিবাহের প্রথা সীমারেখা ছাড়াই প্রচলিত ছিল। কোনো কোনো সাহাবায়ে কেরামের বিবাহে চারের অধিক স্ত্রী ছিল। হযরত খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকালের পর মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর বিবাহে বিশেষ বিশেষ দ্বীনি প্রয়োজনে দশজন পর্যন্ত স্ত্রী একত্রিত হয়েছিল।
অতঃপর যখন বহু বিবাহের কারণে মহিলাদের অধিকার খর্ব হতে লাগল। মানুষ প্রথমত লোভের বশবর্তী হয়ে অধিক বিবাহ করত। পরবর্তীতে স্ত্রীদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে ব্যর্থ হত। তখন
কুরআনুল কারিমের চিরস্থায়ী বিধান, যা দুনিয়া থেকে জোর-জুলুমকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার জন্যই নাযিল হয়েছে; মানুষের স্বাভাবিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়নি; বরং নেতিবাচক দিকগুলো সংশোধনে এর সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ নাযিল হয়
“এখন তোমরা চারজন স্ত্রীকে একই সাথে বিবাহ করতে পারবে। তা এই শর্তে যে, যদি সমান ভাবে সকলের হক আদায় করতে পার। যদি না পার তাহলে একাধিক স্ত্রী রাখা অন্যায়।”
এই নির্দেশের পরে চারজন থেকে বেশী স্ত্রী রাখা উম্মতের ঐক্যমতে হারাম প্রমাণিত হল। যে সকল সাহাবীর বিবাহে চারের অধিক স্ত্রী ছিল তারা চারের অতিরিক্ত স্ত্রীগণকে তালাক প্রদান করেন।
হাদিস শরীফে আছে, হযরত গায়লান (রা.) যখন মুসলমান হলেন তখন তাঁর বিবাহে দশজন স্ত্রী ছিল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ তাকে হুকুম প্রদান করেন যে, চারজন রেখে অতিরিক্ত স্ত্রীগণকে তালাক দিয়ে দাও।
হযরত নওফেল ইবনে মুয়াবিয়া (রাঃ) যখন মুসলমান হলেন, তখন তার বিবাহে পাঁচজন স্ত্রী ছিল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ তাদের একজনকে তালাক দান করার হুকুম দিলেন।
(তাফসিরে কাবির, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ১৩৭)।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর বহু বিবাহের কারণ
মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর পবিত্রতমা বিবিগণের সংখ্যা ও এই সাধারণ আইনানুযায়ী চারজনের বেশী না থাকা উচিৎ ছিল। কিন্তু এ কথা প্রকাশ থাকে যে, উম্মাহাতুল মুমিনিন (মুমিনদের মাতাগণ) অন্যান্য মহিলাগণের মত নন। কুরআন করিম স্বয়ং ঘোষণা করেছে:
يانساء النبی الستن کاحد من النساء
” হে নবী পত্নীগণ! তোমরা সাধারণ মহিলাগণের মত নও।”
তারা সমস্ত উম্মতের মাতা। মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এরপর তারা কারাে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন না। এখন যদি সাধারণ আইনে আওতায় চারজন বিবি ছাড়া অন্যান্য বিবিগণকে তালাক প্রদানের মাধ্যমে আলাদা করা হত তাহলে তাদের উপর কতইনা জুলুম করা হত যে, এখন তারা সারা জীবন নিঃসঙ্গ হয়ে থাকতে হত। এবং রাহমাতুললিল আলামীন (সা.)-এর সামান্য কদিনের সহচর্য তাদের জন্য আজাবে পরিণত হত। এক দিকে তাে মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ -এর সহচার্য ছুটে যেত। আবার অন্য দিকে তাদের কোথাও দুঃখ মোচনের অনুমতিও থাকত।
এ জন্যই মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ -এর স্ত্রীগণকে সাধারণ আইনের আওতায় আনা সমীচীন ছিলনা। বিশেষত সমস্ত স্ত্রীগণের সাথে (হযরত আয়েশা (রা.) ব্যতীত) বিবাহ এ জন্যই অনুষ্ঠিত হয়েছিল যে, তাদের স্বামীগণ জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়ে ছিলেন এবং তাদের সহমর্মিতার জন্যই তাদেরকে বিবাহ করেছিলেন। এখন যদি তাদেরকে তালাক দেওয়া হত তাহলে তাদের কি অবস্থা হত!
এ জন্য শরীয়তের হুকুমে চার জনের বেশী স্ত্রী রাখা শুধু মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এরই বিশেষত্বে পরিগণিত হয়। এ ছাড়া তার সাংসারিক জীবনের অবস্থা সমূহ, যা উম্মতের জন্য ইহকাল ও পরকালে যাবতীয় কাজ কর্মের বিধিবদ্ধ আইন রূপে গণ্য, তা শুধু পবিত্রতমা বিবিগণের দ্বারাই পৌছতে পারত এবং আর এর জন্য নয়জন স্ত্রীও কম ছিল।
এই বাস্তবতার প্রতি লক্ষ্য করে কোনো মানুষ কি একথা বলতে পারে যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ -এর এই বৈশিষ্ট্য (নাউযুবিল্লাহ) জৈবিক লোভ লালসার উপর নির্জনশীল ছিল?
►► আরো পড়ুন: হযরত মুহাম্মদ সা: এর পবিত্র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী
►► আরো পড়ুন: যেভাবে কাটতো রাসুল (সা.)-এর দিনরাত
►► আরো পড়ুন: ইসলামে দাড়ি রাখার বিধান ও এর উপকারিতা
►► আরো পড়ুন: অজুতে নাকে পানি দেওয়ার উপকারিতা
►► রাসুল (সা.)-এর সীরাত সম্পর্কে জানতে ভিজিট করুন নবীজি.কম এ
এর সাথে এ কথাটিও লক্ষনীয় যে, সে সময় সারা আরব ও অনারব মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ -এর বিরোধিতায় দাঁড়িয়েছিল। তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। এই দেদীপ্যমান সূর্যের উপর ধুলাবালি নিক্ষেপ করার জন্য সকল প্রকারের শক্তি প্রয়োগ করে নিজেরাই লাঞ্ছিত হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও কাফেররা কোনো দিন তার উপর জৈবিক লোভ-লালসা এবং নারী সংগঠিত ব্যাপারে কোন অভিযোগ তুলতে পারে নি।
যদি সামান্য আঙ্গুল রাখিবার সুযোগ হত তাহলে আরবের কাফেরেরা; যাদের নিকট নবীর ঘরের খরব পর্যন্ত গোপন ছিল না, তারা সবচেয়ে বেশী অনুসন্ধান করে বহু বিবাহকে তার দোষ-ত্রুটির মধ্যে গণ্য করত। পরহেজগারির মূর্ত প্রতীক রাসুল (সা.)-এর পবিত্র জীবন তাদের চোখের সামনে ছিল। যার মধ্যে তারা দেখতে পাচ্ছিল যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ -এর যৌবন কালের বড় অংশটি তো শুধু একাকীত্ব ও নির্জনতার মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। তারপর যখন তার বয়স ২৫ বৎসরে পৌঁছল তখন হযরত খাদীজা (রা.)-এর পক্ষ হতে বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া হল। যিনি বিধবা ও সন্তানবতী হওয়ার সাথে সাথে ৪০ বৎসরে উপনীত হয়ে বার্ধক্যের যমানা অতিক্রম করছিলেন। তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর সাথে বিবাহের পূর্বে দুইজন স্বামীর সংসার করেছিলেন এবং দুই ছেলে তিন মেয়ের মা হয়েছিলেন। (সীরাতে মােগলতাঈ, পৃষ্ঠা ১২)
হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর পক্ষ হতে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয় নি। প্রায় পঁচিশ বছর জীবন এই বিবাহে অতিবাহিত করেছেন। এমনভাবে যে, হযরত খাদিজাকে ঘরে রেখে হেরা পর্বতের নির্জন গুহায় শুধু আল্লাহর ইবাদতে কাটাতেন। জীবনের বড় অংশ এই বিবাহেই কাটিয়েছেন। এজন্য রাসুল (সা.)-এর যত সন্তানাদি জন্ম হয়েছিল তাদের সবাই (হযরত ইবরাহীম (রা.) ব্যতীত) হযরত খাদিজা। (রা.) এর গর্ভজাত ছিলেন।
অবশ্য হযরত খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকালের পর তার বয়স যখন পঞ্চাশ বৎসর অতিক্রম করল, তখন অন্যান্য বিবাহ সংঘটিত হয়। শরীয়তের বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে দশজন স্ত্রী তাঁর সাথে বিবাহে আবদ্ধ হন। যাদের (হযরত আয়েশা (রা.) ছাড়া) সকলেই ছিলেন বিধবা। তাদের কেহ কেহ সন্তানবতীও ছিলেন।
বিশেষ করে যখন আরবের কাফেররা ও কুরাইশ সরদারগণ তাঁর ইশারা মাত্রই নিজেদের নির্বাচিত লাবণ্যময়ী সুন্দরীকে তাঁর পদতলে উৎসর্গ করে দিতেও তৈরি ছিল। যেমনটি সীরাত ও ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য কিতাবাদিতে তার প্রমাণ রয়েছে। এতদ্ব্যতীত তখন মুসলমানের সংখ্যাও লাখের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। যাদের প্রতিটি মহিলা হযরত মুহাম্মদ ﷺ -এর পত্নী হওয়াকে সঙ্গত কারণেই উভয় জগতের সফলতার মাধ্যম মনে করতেন। এই সবকিছু থাকা সত্ত্বেও হযরত মুহাম্মদ ﷺ -এর পঞ্চাশ বৎসর বয়স পর্যন্ত শুধু হযরত খাদিজা (রা.) ই ছিলেন তার পত্নী। যার বয়স বিবাহের সময়ই চল্লিশ বৎসর ছিল।
তারপর যে সকল মহিলাকে বিবাহের জন্য মনোনীত করা হল। তাদের একজন ব্যতীত সকলেই ছিলেন বিধবা এবং সন্তানের মাতা। উম্মতের অসংখ্য কুমারী মহিলাদিগকে তখনও নির্বাচিত করা হয়নি।
এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে বিস্তারিত লেখার সুযোগ নেই। নতুবা দেখানো যেত যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ -এর একাধিক বিবাহ কি পরিমাণ ইসলাম ও শরীয়ত সঙ্গত প্রয়োজনের উপর প্রতিষ্ঠিত বা নির্ভরশীল ছিল। এমনকি যদি নবী স্ত্রীগণ না হতেন, তাহলে সে সব আহকাম যাহা শুধু মহিলাগণের মাধ্যমেই উম্মতের নিকট পৌছানো সম্ভব ছিল। তা অজানাই থেকে যেত।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ নয়জন পবিত্রতমা বিবি পরিত্যাগ করে ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর সর্বপ্রথম পবিত্রতমা বিবিগণের মধ্যে থেকে হযরত জয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.) ইন্তেকাল করেন এবং সর্বশেষ হযরত উম্মে সালমা (রা.) ইন্তেকাল করেন। |